গল্প করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল
পড়লো। ঘড়িতে যখন সাড়ে পাঁচটা বাজে, ও উঠে বলল “এই বিকাল হল, চা খাবে?”। আমি বললাম
“চা তো রোজই খাই এমন বিকাল কি রোজ রোজ আসে?” ওর লম্বা চুল তখনও আমার কোলের ওপর
আমার অর্ধেক শরীর ঢেকে রয়েছে। আমার খুব ভালো লাগছিলো। আমি ওর চুলের গোছাটা ধরে
আলতো করে টান দিয়ে বললাম “যেয়ো না প্লিজ।” ও বলল “আরে আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?
এখানেই তো আছি। তুমিও এসো রান্নাঘরে দুজনে চা বানাই। এসো।” তারপর আমার হাত ধরে
টেনে তুলে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে নিজে গ্যাস জ্বালিয়ে চা করতে লাগলো। আমি ওকে দেখতে
থাকলাম।
পড়নে আটপৌড়ে হলদে শাড়ী, সবুজ ব্লাঊজ।
খোলা চুল ওর কাঁধ, ঘাড়, ওর কোমরের নীচ অবধি ঢেকে রয়েছে। দেখে মনে হয়না আদৌ কখনও
কোনও বিশেষ যত্ন পেয়েছে। অথচ তবু কি সুন্দর, যেন প্রকৃতি সব সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে
নিজে থেকেই। যত্নের অভাবে ওগোছালো, অসমান, ডগাগুলো এবড়ো খেবড়ো। কিন্তু কি নরম, যেন
কাশ্মীরি পশম।
ওকে জিগ্যেস করলাম, “তুমি চুল কাটনি কতদিন?”
ও চা করতে করতেই উত্তর দিল “চুল আমি
কোনোদিনই কাটিনি। আগে মা কাটতে দিতো না। বিয়ের পর আর কাটা হয়নি।”
আমি জিগ্যেস করলাম “কেন?”
- “এমনই,
আগে বিয়ের আগে একবার ইচ্ছে হয়েছিল স্টাইল করে কাটবো, পার্লার অবধি গিয়ে ফিরে
এসেছিলাম”।
- “কেন?”
- “মায়া
হয়েছিল। যদি খুব ছোটো হয়ে যায়, ভয়ে, একটু লজ্জাও লেগেছিল। লোকে কি বলবে”।
আমি আর কিছু বললাম না। ওকে দেখছিলাম। ও পিছন ফিরে চা করছে। ওর চুল ওর মাথা থেকে নেমে ওর ঘার, পিঠ, কাধ, কোমর নিতম্ব সব ঢেকে রয়েছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন সব মেয়েরা রুপের পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করছে তখন ও নাকি চুল কাটতে লজ্জা পায়, লোকে কি বলবে। ওর লজ্জা ঢাকার জন্যে ওর চুলই যথেষ্ট। ওকে এই অবস্থায় দেখে মনে হল না লজ্জা ঢাকার জন্যে ওর জামা কাপড় দরকার। আমার মনে হল চুল টা যদি বাদ দিই তবে কি আর কিছু আছে ওর? ওর চা করা হয়ে গিয়েছিল। দুজনে কাপ হাতে উঠোনে এসে বসলাম। ওকে লক্ষ্য করছিলাম। ওকে দেখতে কুৎসিত নয়। যত্ন পেলে ওকে আর পাঁচটা মেয়ের থেকে ভালোই দেখাবে তাতে সন্দেহ নেই। তবে অবশ্যই ওর চুলের সৌন্দর্য ওর শারীরিক সৌন্দর্য কে ছাপিয়ে যায়। ওর আর কোনও গয়নার প্রয়োজন নেই কোনও সাজের প্রয়োজন নেই। তখনই আমার মনে হল কেন নয়? কোনও সাজ ছাড়াই যাকে এত সুন্দর দেখায় সাজলে না জানি কেমন দেখাবে। আচ্ছা ওর চুল অত লম্বা না হত? ও যদি নিজের দিকে নজর দিত, ও যদি নিয়মিত চুল কাটত বিভিন্ন স্টাইলে, কি ক্ষতি হত? কোন মহাভারত অশুদ্ধ হত যদি ওর চুল অত লম্বা না হত? আমি দেখতে চাই ওকে কেমন দেখাবে ঘাড় অব্দি স্টেপ কাট চুলে। ওর লজ্জা, ভয়, আমি জানতে চাই না। ওকে কাটতেই হবে। নিজের মধ্যে একটা জেদ অনুভব করলাম, ওকে বদলাতেই হবে। ওর স্বামী না দেখতে চাইতে পারে, আমি দেখতে চাই।
দুজনেই চুপচাপ চা খাচ্ছিলাম। আমি ওকে দেখছিলাম আর ও দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল আনমনে। চা খাওয়া হলে ও দুজনের কাপ নিয়ে উঠে রান্না ঘরের দিকে গেল। আমি জানি এবার ও চুল বাধবে। সন্ধ্যে দিতে দেরি আছে। আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর বিছানায় গিয়ে বসলাম। যথারীতি ও রান্নাঘরের কাজ সেরে ঘরে ঢুকল। ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো। আমি বললাম,
- “মুন”
- “উঁ”
- “বাড়িতে কাঁচি আছে?”
- “কাঁচি? কি করবে?”
- “তোমার চুলের ডগাটা সমান করে দেবো”।
ও হাসল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরল।
হাতে একটা মাঝারি সাইজের কাঁচি। বলল,
- “এতে হবে?”
- “খুব হবে, দাও,
আর তুমি এখানে দাড়াও।”
বলে ওর হাত থেকে কাঁচি টা নিয়ে ওকে আয়না থেকে দূরে এনে
আয়নার দিকে পেছন ফিরিয়ে দাড় করালাম। বিছানায় একটা সিঙ্গেল চাদর ভাঁজ করে রাখা ছিল।
সেটা খুলে ওকে বললাম চুলটা তুলে ধর। ও ধরল। আমি চাদর টা ওর গলায় কেপের মত বেঁধে
দিলাম। ও চুল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আমি ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা
রাবার ব্যান্ড তুলে নিয়ে ওর চুল টা গোছা করে ঘাড়ের কাছে একটা পনিটেল করে বেঁধে
দিলাম। ও বাধ্য মেয়ের মত অপেক্ষা করতে থাকল। আমি ওকে এবার বললাম,
- “মুন”
- “হু?”
- “একদম নড়বে না”
- “আচ্ছা”
আমি কাঁচি টা তুলে নিলাম। তারপর কিছু শব্দ হল, কিন্তু ও
একটাও আওয়াজ করল না। ওর চুলের মোটা গোছাটা কাটতে বেশ জোর দিতে হচ্ছিল আমায়। মিনিট
পাঁচেক সময় লাগলো, কাঁচির শব্দের তালে তালে ওর মাথাটা অল্প অল্প নড়ছিল। তারপর তিন
ফুট লম্বা চুলের গোছা টা আমার হাতে আলাদা হয়ে এল। ও যেন পাথর হয়ে গেছে। নড়ছে না।
সাড়া দিচ্ছে না। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি এক ঝটকায় চিরুনি টা তুলে
নিয়ে তারাতারি হাত চালাতে লাগলাম। মিনিট পনেরর মধ্যে কাজ শেষ করে ওর মুখের দিকে
তাকিয়ে দেখি ওর দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। আমি ওর গা থেকে টুকরো চুল ঝেড়ে ফেলে চাদর
টা খুলে নিয়ে ঝেড়ে ভাঁজ করে বিছানায় রেখে দিলাম। ওর পায়ের কাছে তখন কাটা চুলের
টুকরোর স্তূপ। তারপর ওর হাত ধরে টেনে এনে আয়নার সামনে দাঁড় করালাম। তখনও ওর চোখ দিয়ে
জল পড়ছে। এবার আয়নার দিকে তাকিয়েই দু হাতে মুখ ঢেকে টুলটায় বসে পড়লো।
- “এ তুমি কি
করলে?”
- “কেন? তুমিই আমায়
বলেছিলে আমার যা ইচ্ছে আমি করতে পারি তুমি কিছু মনে করবে না”
ও কিছু বলল না। আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর
স্বাভাবিক হল আরও কিছুক্ষণ পর। ওর কাঁধ ছুঁই ছুঁই ঢেউ খেলানো চুলে ওকে আগের থেকে
বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে। ওর বয়স যেন দশ বছর কমে গেছে। এরসঙ্গে আরেকটা ব্যাপার যেটা
আমি আগে ভাবিনি, ওর লম্বা চুল না থাকাতে ওর পিঠ, কাঁধ, গোটা শরীর যেন উন্মুক্ত। সেই
একই জামা কাপড় পরা অবস্থাতেও অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। আমি ওর পিছনেই
দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওর ঘাড় ঢাকা চুল ঘাঁটছিলাম মনের সুখে। অদ্ভুত সুন্দরী
দেখাচ্ছিল ওকে যা আগে কখনও ওকে দেখে মনে হয়নি।
ওর সেই লম্বা চুলের গোছাটা আমার কাছেই রেখে দিয়েছিলাম
সেই সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি হিসাবে।
No comments:
Post a Comment